সাদা কালো
-সুমিতা দাশগুপ্ত
“একি বুবুসোনা, তুমি এখনও কেঁদেই চলেছো? অনেকক্ষণ কেঁদেছো, নাও এবারে কান্নাকাটি থামাও।”
“কী করবো মা, আমার যে খুব কান্না পাচ্ছে। ঐ দুষ্টু লোকেরা মিলে মিছিমিছি ভালো দাদুটাকে মারলো কেন?
জানো মা,রোজ সকালে মোবাইলের ইস্কুল শেষ হয়ে গেলে,’বাই বাই ম্যাম্’ বলে আমি যখন দোতলার এই বারান্দাটায় বসে বসে রাস্তা দেখি তখনই রোজই দেখতে পাই রায়দাদুর বাচ্চা নাতিটাকে নিয়ে ওদের আয়ামাসি রাস্তা পেরিয়ে ঐ পার্কে বেড়াতে নিয়ে যায়, আর সেখানে গিয়েই বাচ্চাটাকে একা ছেড়ে দিয়ে বেঞ্চিতে বসে, অন্য আয়ামাসিদের সঙ্গে গল্প করে। বেবিটা একা একাই টলমল করে এদিকে ওদিকে হেঁটে বেড়ায়। কখনো হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েও যায়। আয়ামাসি দেখলেও ওকে তুলে দেয় না, শুধু গল্প করেই যায়। আজ ওরা যখন নিজেরা গল্প করছিল, তখন বেবিটা যে আপনমনে একা একা গেটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখতেই পায় নি। বেবিটা আপনমনে একা একা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস ঐ রাস্তায় চা ফিরি করা চা’ওয়ালা দাদুটা দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো! না হলে আর একটু হলেই রাস্তায় নেমে গেলে কী সাংঘাতিক কান্ড হতো বলো! কোথায় দাদুটাকে সবাই থ্যাঙ্ক ইউ বলবে তা না ঐ আয়ামাসিরা সবাই ছুটে এসে ওকে ছেলেধরা বলে লোকজন জুটিয়ে কতো মারলো। আমি এখান থেকে কত চেঁচালাম, বললাম ওকে মেরো না, ও ভালো লোক, কেউ শুনতেই পেল না। ভাগ্যিস ট্রাফিক পুলিশকাকুটা, দাদুটাকে চিনতে পেরে এসে বাঁচালো! জানো মা দাদুটার কপাল কেটে রক্ত পড়ছিলো। কেন মা ওরা ভালো দাদুটার সঙ্গে ঐ রকম করলো?”
” কী আর বলি বলো। আসলে নিজেদের গাফিলতি আর অন্যায়, চাপা দিতেই ওরা এমনটা করেছে। মানুষের স্বভাবটাই যে এইরকম, নিজের অপরাধের দায় সবসময় অন্যের উপরে চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চায়।”
” কেন মা? নিজে দোষ করলে অন্যকে কেন শাস্তি পাওয়াবে? আমাদের ইস্কুলে তো এইরকম হয় না। বড়ো হলেই কী মানুষই এইরকম হয়ে যায়?”
“না সোনা সবাই এইরকম হবে কেন? চারপাশে দেখো না, এই দুঃসময়েও নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কত মানুষ নীরবে কত ভালো কাজ করে যাচ্ছেন।
নাও এখন মনখারাপ না করে একটা ছবি এঁকে আমাকে দেখাও তো দেখি।”
“কীসের ছবি আঁকবো?”
“যা ইচ্ছে হয়। এই তো তোমার আশেপাশেই তো কতো কিছু আছে।”
“কিন্তু মা আমার রঙপেন্সিলের বাক্সটা যে কাল রান্না মাসির ছেলেটাকে দিয়ে দিলাম।রঙ তো করা যাবে না। ”
“ঠিক আছে, সাদা কালো ছবিই আঁকো না হয়।”
চারপাশে চেয়ে বুবুর নীচের বাগানে ফোটা গন্ধরাজ ফুলগুলো মনে ধরে গেল, কিন্তু একটাই সমস্যা। সাদা কাগজে সাদা ফুল ফুটিয়ে তোলা যাবে কী করে! অতঃপর সে সাদা কাগজে গন্ধরাজ ফুল এঁকে, ফুলগুলোর চারপাশটা কালো রঙ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলো, দিতেই থাকলো, যতক্ষণ না সেগুলি রাতের আকাশে তারার মতো ফুটে ওঠে। এছাড়া আর কী-ই বা সে করতে পারতো এই সাদা কালোর দুনিয়ায়!